প্রশ্নটা তো সহজ, আর উত্তর তো জানা – দৈনিক সাতক্ষীরা সংবাদ

প্রশ্নটা তো সহজ, আর উত্তর তো জানা

লেখক/প্রতিবেদকঃ
প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২২

পরীক্ষার প্রশ্ন সবার জন্য একই থাকলেও সবার উত্তর একই হয় না, ফলাফলেও থাকে ভিন্নতা। শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কিছু শিক্ষার্থী অনেক না লিখেও যথাযথ উপস্হাপন ও যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে ভালো নম্বর পায়। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থী প্রশ্নের বক্তব্য ঠিকভাবে না বুঝেই অনেক কিছু লিখেও ভালো করতে পারে না। একই দৃশ্য দেখা যায় মৌখিক পরীক্ষাতে। শিক্ষার্থীরা হয়তো ভাবে, তাতে করে শিক্ষকরা বুঝবেন—সে জানে কিন্তু বলতে পারছে না। তবে তাতে ফলাফল পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ খুব কমই থাকে। শিক্ষার্থীদের সব সময় বলি, অনেক কথা বললেই যে ভালো নম্বর পাবে, তা নিশ্চিত নয়। বরং উত্তরটা হতে হবে প্রশ্নের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, যা পরীক্ষককে ভালো মূল্যায়নে উত্সাহিত করবে।

শিক্ষার্থীদের বিষয়টি ভিন্ন। কেননা তাদের চিন্তা অপরিপক্ব, লক্ষ্য ভিন্ন। কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হওয়াই প্রত্যাশিত। অথচ অনেক কিছুতেই আমরা দেখছি গতানুগতিক ধারা, সবাই যেন উত্তর আগে থেকেই ঠিক করে রাখেন। যে কোনো ঘটনা ঘটুক, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এ বিষয়ে জিগ্যেস করলেই তোতা পাখির মতো কথা বলেন। যেমন, কোনো এলাকায় অপরাধমূলক কোনো ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তার উত্তর একই, ‘আমরা অপরাধীদের ধরার চেষ্টা করছি’, বা ‘এ বিষয়ে কেউ আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি’, অথবা ‘তদন্েতর স্বার্থে সবকিছু বলা যাবে না’। আপাতদৃষ্টিতে তাদের এমন বক্তব্য স্বাভাবিক, কিন্তু মানুষ ফলাফল দেখতে চায়। শুধু পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্হা নয়, সব ক্ষেত্রেই একই বাস্তবতা।

যদি কোনো সিটি মেয়রকে প্রশ্ন করা হয় নগরের জলাবদ্ধতা বা মশার সমস্যা নিয়ে, সেখানেও নতুনত্ব নেই। ‘আমরা চেষ্টা করছি, আশা করছি শিগ্গিরই নগরবাসী এ সমস্যা থেকে মুক্ত হবেন’; ‘আমরা নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি’; ‘মশা নিধনের জন্য নতুন ওষুধ কেনার কাজ চলছে’, ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সঙ্গে হয়তো বলবেন, অতীতের মেয়রের সময় কোনো কাজ করা হয়নি বলেই এখন এত সমস্যা হচ্ছে। শেষে যুক্ত করবেন, প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা ও যোগ্য নেতৃত্বে আমরা অচিরেই সব সমস্যার সমাধান করব, ইনশাআল্লাহ।

টেলিভিশন টক শোগুলোতেও একই দৃশ্য। আলোচনার বিষয় যা-ই হোক না কেন, আলোচকরা যে কোনো মূল্যে সরকারের গুণগান বা দোষারূপ করবেনই। সেই সঙ্গে থাকবে নিজ দলের নেতার জন্য তোষামোদের বাণী। বাংলা ব্যাকরণে যত বিশেষণ আছে, এর কোনোটাই বাদ যায় না। দায়িত্ব নিয়ে দলের বা সরকারের ব্যর্থতা মেনে নিতে কিংবা অন্যদের যৌক্তিক সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা ও সাহস কজন দেখান। কখনো কখনো পরিস্হিতি এত বাজে হয় যে, তারা ভুলেই যান দর্শকের কথা।

একই দৃশ্য রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে। বক্তা যে-ই হোন না কেন, বক্তব্য শুরু হয় দলীয় নেতার গুণকীর্তন দিয়ে, এরপর নিজ দল বা সরকারের উন্নয়নের হাজারো বর্ণনা, কিন্তু একবারও নিজেদের ব্যর্থতা নিয়ে একটা শব্দও ব্যয় করেন না। এর পরই শুরু হবে আসল চমক। প্রতিযোগিতা শুরু হয় বিরোধী দলের সমালোচনা করার। শেষে আমরা কী বুঝি? উন্নয়ন যা হয়, তা সরকারের, আর ব্যর্থতা সব বিরোধী দলের। আহ্! কী চমৎকার চক্র! যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলছে, জনগণ তো হাঁদারাম-গাধারাম, তাদের অনুভূতি বলতে কিছু নেই।

রমজান আসার আগেই বলা হয়, পণ্যের প্রয়োজনীয় মজুত আছে, মূল্য সহনশীল থাকবে। কিন্তু এর পর কি হয়, তা আর না-ই বললাম। জিগ্যেস করলে একই উত্তর, ‘আমরা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছি, পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। পণ্য মজুত বা মূল্য বৃদ্ধি করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ যদি কোনো আলোচিত ধর্ষণ বা হত্যাকাণ্ড বা দুর্নীতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কাউকে কিছু জিগ্যেস করেন, তাহলে নতুন কিছু শুনতে পারবেন না। শুনবেন, ‘আইন সবার জন্য সমান, কেউ অপরাধ করে পার পাবে না। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান করে অভিযুক্তদের বিচারের সম্মুখীন করা হবে।’ আজও বুঝতে পারলাম না, অতি দ্রুত সময়ের সীমা বা বাজার মনিটরিংয়ের অর্থ কী? এ রকম বহু আলোচিত ঘটনার সুরাহা হয়নি।

যখন মাঝনদীতে ফিটনেসবিহীন লঞ্চের সংঘর্ষ হয় বা পদ্মায় অনুমোদনহীন স্পিডবোটের ধাক্কায় ডজন ডজন মানুষ মরে, তখনো একই চিত্র। কারো যেন কোনো দায় নেই, কেবল নীতিবাক্য আর অন্যদের অভিযুক্ত করা। তারা জানেন, কিছু দিন গেলেই আমরা সব ভুলে যাব, তখন আর এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকবে না। নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য সেই একই সুরে, ‘বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে’। একই সঙ্গে নিজেদের প্রশংসা নিজেরাই করার সাহসও দেখা যায়। গাড়িচাপায় একই পরিবারের পাঁচ সন্তানের অকালমৃতু্য আমাদের বিবেক জাগ্রত হয় না। ফিটনেস ও লাইসেন্স ছাড়া চালক গাড়ি চালায় আর মারা যায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষ। এর পরও দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই।

যখন ভবন হেলে পড়ে, কেবল তখনই জানা যায়, এর অনুমোদন ছিল না। যখন সরকারি উচ্ছেদ শুরু হয়, কেবল তখনই আমরা জানতে পারি কিছু মানুষের দখলবাজির নমুনা। নীতিমালা থাকার পরও যখন ভূমিহীনদের জন্য বরাদ্দ জমি পায় বিত্তবানরা, তখনই আমরা বলি, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’ যখন আবরারের নিথর দেহ পাই, কেবল তখনই আমরা সোচ্চার হই, এর আগে নয়।

আমরা কবে দায়িত্বশীল হব, কবে দায়িত্ব অবহেলার জন্য নিজের সমালোচনা করতে পারব, কবে আমরা নিজের ভুল বা ব্যর্থতা স্বীকার করতে শিখব? আমরা সাধারণ মানুষও এ রকম কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মানুষ এখন আর সহজে কথা বলতে চায় না। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, আমাদের বোধশক্তি, অনুভূতি ও আবেগ লুপ্ত হয়ে গেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতেই হবে, দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য। মনে রাখা দরকার, শিক্ষক শুধু শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেন, কিন্তু নেতা বা দায়িত্বশীলদের পরীক্ষক হচ্ছেন দেশের জনগণ। কোনো না কোনো সময় তাদের কাছে পরীক্ষা দিতেই হবে।

লেখক: শিক্ষক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট

সোর্সঃ ইত্তেফাক